জোবায়ের মিলন এর সাক্ষাৎকার প্রকাশ ।। পেখম



         জোবায়ের মিলন সমসাময়িক একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি।  জন্ম ২০ফেব্রুয়ারি, ১৯৮১ইং । ঢাকা, ডেমরায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় স্নাতোকত্তর,ব্যবস্থাপনায়,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। জীবন নির্বাহের প্রয়োজনে এনটিভিতে সংবাদকর্মী হিসেবে আছেন। কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে ২টি (স্বৈরাচারী দুঃখ ও বিবিধ-২০২২ বইমেলা, ঘনসাপের দেউড়ি-২০২৩ বইমেলা) । নিয়মিত লিখছেন ছোটো-বড় কাগজে ও দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে। কবিতা প্রধান ধ্যান হলেও সাহিত্যের সমালোচনা, সমসাময়িক বিষয়ে কলাম, শিশুর মানসিক বিকাশে কর্তব্য-করণীয় ফিচার, ছোটো গল্প, ছড়া ও শিশুগল্প লিখছেন । তার কবিতাযাপন ও অন্যান্য বিষয়ের ওপর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও সম্পাদক দ্বীপ সরকার


 কুয়াশা মে সংখ্যা/২৩ পড়তে ভিজিট করুন



পেখমঃ লেখালেখি শুরুর কোন ইতিহাস আছে কি? থাকলে একটু বলুন। এবং প্রেরণার কোন জায়গা আছে কিনা?



জোবায়ের মিলনঃ প্রত্যেক লেখকেরই শুরুর একটি ইতিহাস থাকে হয়ত মোটা দাগে হোক বা চিকন দাগে । আমার বেলায় মোটা কোনো দাগ নেই। ছোট বেলায় কখন কোন সময় আমার মধ্যে লেখার বীজ বপন হয়ে যায় মনে নেই। শুধু মনে আছে, পড়তে বসে একদিন আচমকাই রাফ খাতায় একটি ছড়া লিখে ফেলি। আমরা ভাই-বোনেরা- বিশেষ করে আমরা দুই ভাই এক টেবিলে পড়তে বসতাম। ভাই হয়ে কী করে বোনদের হাত ধরে ঘরে সবার মধ্যে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে বলতে পারছি না। পরে সবাই একসাথে হয়ে ছড়াটি পড়ে এবং আমাকে উৎসাহ দেয়। সেখান থেকেই শুরু। বিশ্বাস করুন, আমার প্রেরণনার জায়গাটা একেবারে ফাঁকা। আমি কারো কাছ থেকে সরাসরি প্রেরণা পাইনি। বাবার মৃত্যুর অল্পকিছু সময় আগে তার সহযোগিতা ছাড়া পেয়েছি। পরিবারের সবার প্রেরণা ঠিক ওভাবে না পেলেও তারা আমাকে নিষেধ করত না আবার উজিয়েও দিত না। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকা পড়ার একটা অভ্যাস আমার তৈরি হয়। সম্পাদকীয় এবং ফিচার টানতো। অসঙ্গতিগুলোও টানতো। নানান বিচ্যুতিতে নিজের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি হত, কথা তৈরি হত। পত্রিকার যে লেখাটি পছন্দ হত তা পড়তাম আর যে লিখেছে তার নামের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতাম, আমার স্পষ্ট মনে আছে। ভাবতাম, কী করে এত সুন্দর করে লেখে! আমার মনে হত- যারা লেখে তারা মহৎ মানুষ। সো আমার মধ্যে গ্রো হতে থাকে একটা গতিশীল লেখক সত্ত্বা। আমি মনে করি, পত্রিকা পড়া ও ওই লেখাগুলোই আমার সবচে বড় প্রেরণা।  




পেখমঃ যতটুক জানি আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্থ বেরিয়েছে ২০২২ বইমেলায়। কিন্তু এত দেরিতে বই করার কারণ কি? এখনকার প্রজন্ম তো দ্রুত কবি হওয়ার অস্থিরতায় খুব দ্রুতই বই করেন। এ ক্ষেত্রে আপনার মতামত কি?

জোবায়ের মিলনঃ জ্বী, ২০২২ইং বইমেলায় আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘স্বৈরাচারী দুঃখ ও বিবিধ’ প্রকাশিত হয় পেন্সিল পাবলিকেশনস্ থেকে তাদের একটি পান্ডূলিপি পুরস্কারের মাধ্যমে। আর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘ঘন সাপের দেউড়ি’ বের হয় ২০২৩ বইমেলাতে। ২০২৩ই বা ২০২২ইং এটাও আমার জন্য কথিতভাবে বিলম্ব বলতে পারেন কিন্তু আমি এটাকে বিলম্ব ভাবি না। আমার মতে ঠিক আছে। সময়টা নিয়েছি মূলত নিজেকে পুষ্ট করতে। বইয়ের সংখ্যার প্রতি আমার চোখ ছিল না, নেই। আমি চেয়েছি লিখতে লিখতে কবিতাগুলো একটু পরিপক্ক হোক, কবিতাগুলো বয়স পাক, তারপর প্রকাশ হোক। যদিও এর মধ্যে বিভিন্ন সাময়িকী, লিটল ম্যাগাজিন, ম্যাগাজিনগুলোতে নিয়মিত লিখেছি। কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। জ্যেষ্ঠের কাছে, কণিষ্ঠের কাছে পরামর্শ নিয়েছি, আলোচনা করেছি, বুঝতে চেষ্টা করেছি। আমার একটি পাঠকশ্রেণী তৈরি হোক তা আমি চেয়েছি। তাছাড়া সর্বদা আমার মধ্যে কবিতা নিয়ে একটা দ্বিধা কাজ করত যে, আমার কবিতা কি কবিতা হয়? এখনও এটা কাজ করে। কারো সম্পর্কে আমার কোনো মতামত বা পরামর্শ নেই। কেননা, আমি নিজেই তো এখনও নিজের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল না যে, আমি কবি কিনা। যে নিজেই নিজেকে কবি মনে করে না সে কী-করে অন্যের বিষয়ে মত-প্রকাশ করে? তবে একটি কথা শেয়ার করতে পারি, যেকোনে কাজই প্রাথমিক অবস্থায় বিস্তর আলোচনার দাবি রাখে। যেকোনো কাজ আলোচনার মাধ্যমে হলে তার থেকে কিছু বিষয় উঠে আসতে পারে যা আদতে উপকার করে। সবকিছুরই ভালো এবং অ-ভালো দিক আছে। বয়স ফেক্ট না, দ্রুত কিংবা বিলম্ব ফেক্ট না, ফেক্ট হচ্ছে কবিতা কতটুকু কবিতা হচ্ছে, তা।



পেখমঃ  আপনার বই ‘স্বৈরাচারী দুঃখ ও বিবিধ’ যেদিন প্রথম স্পর্শ করেন আপনার অনুভূতি কেমন ছিলো?

জোবায়ের মিলনঃ  আমার হাতে আসার আগেই যখন শুনেছি বইটি স্টলে এসেছে তখন থেকে আমার প্রচন্ড-ভয় করছিল, সত্যি ভয় করছিল। হাত-পা কাঁপছিল। সংকোচ হচ্ছিল। আমার চোখ লাল হয়ে উঠছিল। হার্টবিট বাড়ছিল। ভিতরে একটা প্রশ্ন জাগছিল বারবার যে, এ বইটির কবিতাগুলো একটিও ঠিক কবিতা হয়েছে কি? কবিতাগুলো আরও আরও পরিমার্জনের দরকার ছিল, যদিও কবিতাগুলো প্রায় দশ বছরের ঘষামাজা করা। তারপরও। তারপরও। সন্তুষ্ট হতে পারিনি। লজ্জা লাগছিল- কে আমি, কী আমি যে কবিতার বই বের করে ফেললাম! মনে হচ্ছিল, বই বের করার মতো যোগ্য আমি হইনি। সুতরাং এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে গেল না তো? অনেকে হয়ত ভাববে মিথ্যা বলছি, কিন্তু সত্যি বলছি, আমার কোনো শিহরণ হচ্ছিল না।



পেখমঃ ‘স্বৈরাচারী দুঃখ ও বিবিধ’ পাঠককে কেমন জ্ঞান বা স্বাদ আস্বাদনের সুযোগ  দেবে?

জোবায়ের মিলনঃ কবিতাগুলোতে জ্ঞান বিতরণ বা আহরণের কিছু নেই। সময়কে অনুভবের, অনুধাবনের বা অনুমানের সুযোগ আছে। এই বইটিতে প্রধান্য দিয়েছি মূলত বিষাদ এবং বিচ্যুতিকে। আর অন্যভাবে বললে- কবিতা তো কাউকে জ্ঞানী করে না (আমার ব্যক্তিগত মত),দৃষ্টিকে প্রসারিত করে, আত্মপক্ষীয় বোধকে সমৃদ্ধ করে। অনুভূতিকে স্পর্শ করে, শিহরিত বা জাগ্রত করে। এই দুটি দিকেরই উপস্থিত রাখার চেষ্টা করেছি ‘স্বৈরাচারী দুঃখ ও বিবিধ’তে। আছে কি নেই তা আর আমার এখতিয়ারে নেই। তার উত্তর পাঠকের কাছে। ভালো সারা পেয়েছি। পরের বই ‘ঘনসাপের দেউড়ি’তে সারাটা আরেকটু ভালো। তবে দুটির স্বাদ আলাদা।



পেখমঃ কবিতা সাহিত্যের আদি একটা অনুষঙ্গ। এর রূপ-বলয় নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন চিন্তা বা সংঙ্গা নেই। আপনি এ বিষয়ে একটু বলুন?

জোবায়ের মিলনঃ  কবিতার সুনির্দিষ্ট সঙ্গা নেই কিন্তু আছে তো, তাই না? রূপ বলয়ের কোনো মাত্রা নেই, কিন্তু আছে তো। সীমার যেমন নির্দিষ্ট সীমা নেই, কবিতার রূপ-কল্পের, সুন্দরের, সৌন্দর্যের ইত্যাদির সীমা তো আকাশ; যত উপড়ে উঠতে থাকি সীমাও তত উপড়ে উঠতে থাকে; এই মনে হয় ধরতে পারব, এই মনে হয় ধরতে পারছি কিন্তু প্রতিবারই সমান দূরত্বে আকাশ। প্রতিনিয়ত কবিতার সৌন্দর্যকে ভাঙ্গা যায়, ভাঙ্গা হচ্ছে। হবে। আরও পরে আরও হবে। এটা ভাঙ্গতেই থাকবে। কবিতার রূপমাধুর্য বা রূপবলয় যা-ই বলি না কেন, বলার শেষ হবে না। এই যে শেষ হবে না, এর জন্যই এর নাম কবিতা। রহস্যের অমিয় আধার। রহস্যের রহস্য। না হলে এর নাম অন্য কিছু হত, কবিতা হত না।




পেখমঃ ‘পাঠকের সাথে আপোস’ বলে একটা কথা শোনা যায়। আসলে পাঠকের সাথে আপোস করে কাব্য লেখার বিষয়টা আপনার নিকট কেমন মনে হয়?

জোবায়ের মিলনঃ  এটা কি কেউ করে। আমার জানা নেই। শিশুকালে, কৈশোরে হয়ত বন্ধুরের, পরিচিতদের, চেনা-জানাদের, তারপর হয়ত চাক্ষুষ প্রেমিকার মন রক্ষার্থে কিছু তৈরি হয়। তা কি কবিতার মধ্যে ফেলবেন? তা তো না। যখন কবিতা লেখা শুরু হয় তখন এ প্রভাবটা বা মতামতটা মনে হয় থাকে না। কেননা, কবি তো একটা অহম লালন করে অগ্রসর হয় বা অহমটাই তাকে কবি করে তোলে। তবে আরেকটি জায়গায় এই কথাকি সত্য বলে মানি; তা পাঠকের সাথে আপোস না, বিষয়ের সাথে আপোস, ব্যক্তির সাথে আপোস, লাভের সাথে আপোস, লোভের সাথে আপোস, লালসার সাথে আপোস। বিশ্বাসের সাথে না। অনেককেই তো দেখবেন বাটির তেল প্রাপ্তির আশায় অনেক বিষয় নিয়ে জোড় করে কবিতা লিখছে কাউকে কাউকে খুশি করার জন্য। তা প্রকৃত পক্ষে কবিতা না। স্তুতি। সেটি কবিতার অঙ্গনে কোনো বিষয় হতে পারে না। এমনটি ছিল, আছে, থাকবে। আলোর সঙ্গে কালোর বসবাস থাকবেই। কবিতার, কবির স্বর একটিই- অসুন্দরের বিপরীতে, সুন্দরের দিকে। আর যা তা কবিতার প্রাসঙ্গিক না, কখনোই না। এটিকে হিসাবে ধরবেন না।




পেখমঃ ইদানিং কবিতায় বহুরৈখিকতার স্বর দাবীতে গাণিতিক ভাবনা /বিজ্ঞান ভাবনা ঢুকে পড়েছে। যেমনঃ কবিতায় বিভিন্ন সূত্র, চিহ্ন, ইত্যাদি প্রয়োগ দেখা যায়। কেউ কেউ দুর্বোধ্যতার দাবীও তুলছেন। এ বিষয়ে কিছু বলতেন?

জোবায়ের মিলনঃ কবিতার স্বর সুর প্রবহমান। প্রতিনিয়ত বদলায়। কবিতা নীরিক্ষার মধ্যদিয়ে বড় হয় রোজ। আর এটি নতুন না। আগেও হয়েছে। হচ্ছে। শুধু গাণিতিক বা বিজ্ঞান কেন- মেডিকেল শব্দ, যতিচিহ্ন, সুত্র, জ্যোতির্বাদের আকার-ইঙ্গিত আসবে, চারুকলা-চিত্রকলা আসবে মানে আসতেই থাকবে, আসতেই থাকবে। কবিতায় এই আসাটা ভালো । টিকে থাকবে কি, থাকবে না, সেটা কারো পক্ষে সমকালে বলা সম্ভব না। মহাকাল অপেক্ষায় আছে গ্রহণ বর্জনের জন্য। সে-ই বিচারক। অপর দিকে দুর্বোধ্যতা বা সহজতা বলেও কিছু নেই। সময় যখন যাকে যেভাবে আত্মস্থ করে কিংবা অভ্যস্থ হয়ে ওঠে সেটিই কথা। একজন জীবনানন্দ আমাদের বহু কিছু দেখিয়ে গেছেন। কবিকে অনেক অনেক কিছু চিন্তা করতে হয়, আবার না করলেও হয়। কোনো সূত্র দিয়েই কবিতা, কবি উচ্চারণ করা যায় না। এটি মুক্ত, পাখির চেয়েও মুক্ত। পাগলাটে, ভীষণ ক্ষ্যাপাটে। খাপ ছাড়া। পুরোটা। মোট কথা, সৌন্দর্য খর্ব হলেই বিপদ; তা দুর্বোধ্য হোক আর সহজ হোক। না হলে ওকে।



পেখমঃ কবিতায় রাজনৈতিক দর্শন ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। অথচ কবি নজরুলের সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা যেমন প্রকট ছিলো। এখনও আছে। আমরা কি ফুল পাখি প্রেম প্রকৃতির মধ্যেই থাকবো নাকি সবার কিছু একটা লিখা দরকার। এ বিষয়ে আপনার মতামত কি?

 

জোবায়ের মিলনঃ  দেখুন, দর্শনটা আছে। আপনি যদি বিস্তার কবিতার দিকে তাকান তবে এটি দেখতে পাবেন।  আমি তো বলি এখন ফুল পাখির চেয়ে রাজনৈতিক দর্শন নিয়েই কবিতা হচ্ছে বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে সেটি কি উর্ধগামী না নিম্নগামী? নাকী মৌনগামী। অস্পষ্টভাষায় হচ্ছে। বিষাদরূপে হচ্ছে। অতিরিক্ত অলংকারে ঢেকে যাচ্ছে। বুঝতে দেওয়া হচ্ছে না। এরমধ্যেও কবিতার জন্য কারো কারো চাকরি চলে যাওয়ার কথা কি আমারা ইদানিংকালেও শুনতে পাচ্ছি না? কবিতার জন্য নানান চাপে পড়ার কথা কি আমাদের কানে আসছে না?  মনে রাখবেন, সময় অনেক বড় একটি বিষয়। বিজ্ঞ যোদ্ধাকেও সময় বিবেচনায় রাখতে হয়। কবিকেও রাখতে হয়। তবে পাগল কবির সংখ্যা দিন দিন কমছে।  অধিকাংশের মনেই একটি সুপ্ত দানা বেঁধে আছে- ধনি হওয়ার। সবাই ধনি হতে চাচ্ছি, কবি হতে চাচ্ছি না কেউ। কবিতা লিখে বড়লোক হতে চাচ্ছি। পদ পদবী পেতে চাচ্ছি। সেন্সরশিপের আওতায় নিজেকে পুরে রেখেছি। ত্ইা আর ধাক্কাটা সেরকমভাবে হয়ে উঠছে না। অল্পের মধ্যেই যারা করছে আমরা হয়ত ঠিক তাদের ঠিকানাটা পাচ্ছি না। তবে ঝাকি একটা হবে। হয়ত প্রস্তুতি অথবা অপেক্ষা।



পেখমঃ পেশাগত কারণে আপনি অনেক ব্যস্ত মানুষ। লেখার জন্য কোন সময়টা সুযোগ করে নেন?

জোবায়ের মিলনঃ আপনি এটাও হয়ত বিশ্বাস করবেন না, আমার এখন বেশিরভাগ পড়ার এবং লেখার নোট নেয়ার স্থান হচ্ছে লোকাল বাস। আমি অফিসে যেতে এবং আসতে আমার আড়াই তিন ঘন্টা সময় চলে যায়। এই সময়টা আমি চলে যেতে দিই না; বাসে বসে পড়ি, লেখার নোট নিই। অফিসে যাওয়ার সময় হয়ত অনেকদিন তাড়া থাকে কিন্তু অফিস থেকে ফেরার পথে আমি প্রয়োজনে একঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকে সবচেয়ে লোকাল এবং একটা ফাঁকা বাসে উঠি যাতে সময় বেশি ব্যয় হয়। যেন সিটে বসে পড়তে পারি। নিয়মিত পড়ি। মিডিয়ার চাকরি, শিপ্টিং ডিউটি, সংসার, সন্তান, যৌথপরিবারের দেখভাল করে বাসায় পড়ার সময় অনেক বেশি হয় না। তবু রোজ কিছু সময় আমার থাকে। প্রতিদিন বসি বলে সপ্তাহান্তে যোগ করলে অনেকটা সময় হয়। সবচেয়ে বড় কথা আপনি চাইলে সময় ভূতে যোগাবে। আমি চাই। সকাল হোক, দুপুর হোক, রাত হোক। যা-ই হোক, সময় হলেই হয়। মাথার উপড় ফ্যান ঘুরছে কি ঘুরছে না তা আমার জ্ঞানে আসে না। যখন বসি তখন ভাবি, লেখাটা শেষ করতে হবে, পড়াটা শেষ করতে হবে। হয়ে যায়।



পেখমঃ তরুণদের অস্থিরতা থেকে বেড়িয়ে আসার কিছু উপদেশ যদি দিতেন। যদিও আমরাও এখনও তরুনণের বাইরে নই। তবু তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?

জোবায়ের মিলনঃ  উপদেশ আমি দিই না। তরুণরাই জয় করে, করবে এটাই বিশ্বাস। সৎ এবং সুন্দরের পথে থাকলে যেকোনো তরুণের দ্বারা এবং যে কারো দ্বারা অভূতপূর্ব কিছু করা সম্ভব। এলোমেলোভাবে না, ট্রেকে থেকে সঠিক কাজটি যাচাই ও বাছাই করে নিলে তরুণরা পথ দেখাবে। ধৈর্য ধৈর্য ধৈর্য, আত্মবিশ্বাস এবং বিশ্বাস। ভোগ না, ত্যাগ। এগুলো আমি মানি।



পেখমঃ আপনি একজন গণমাধ্যমকর্মী। সাহিত্য বিকাশে বর্তমান গণমাধ্যমের হতাশার জায়গটা যদি বলতেন?

জোবায়ের মিলনঃ যেকোনো মাধ্যম বলেন আর যেকোনো কিছ্ইু বলেন, আর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানই বলেন, যখন পুঁজির নীল ছোবল কারো গায়ে লাগে তা আর মাটি ও মানুষের থাকে না। তারা দুই-ই ব্যবহার করে। আমাদের গণমাধ্যমের দিকে তাকালে শিশুরাও বুঝবে, তারা অর্থের পেছনে ছুটছে। যেখানে, যা-কিছুতে অর্থ আছে তারা তার দিকে সারি বেঁধে দাঁড়াচ্ছে, দৃষ্টি তাক করছে। সাহিত্য বিষয়ে কোনোকালেই গণমাধ্যমের আগ্রহ তেমন ছিল না অথবা সাহিত্য গণমাধ্যমকে পাত্তা দেয়নি কখনো। এখনও । কেউ কেউ দেয়। আমি হতাশ নই, আশাবাদি। সাহিত্যের নিশ্চয় একদিন এমন একটি জায়গা তৈরি হবে যখন সাহিত্যকে গণমাধ্যমের কথা ভাবতে হবে না, গণমাধ্যম সাহিত্যে দরজায় হ্যালো হ্যালো বলে দৃষ্টি আকর্ষণে পরিশ্রম করে যাবে। সবমিলিয়ে এ-বিষয়ে আরও বিস্তর আলোচনার আছে। দুই দিক নিয়েই।



পেখমঃ কবিতায় নিজস্বতা তৈরি যাকে নিজস্ব স্বর বলি। এর গুরত্ব আসলে অনেক। কিন্তু সিংহভাগ কবি এ নিয়ে ভাবছেন না। তারা নিজেকে ভাঙতেও পারছেন না গড়তেও পারছেন না। এ নিয়ে আপনার চিন্তা কি?

জোবায়ের মিলনঃ  হয়ত তারা চেষ্টাটা করছেন না। ওই যে একটু আগে বললাম, কবি হতে চাই না, ধনি হতে চাই; তাহলে ভাঙ্গব কি করে, গড়ব কি করে। ভাঙ্গা গড়ার জন্য কবি হতে হবে। সময়কে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখাতে হবে। সময়ের সঙ্গে মিশে গেলে যে কবিতা হয় না তা আমরা সবাই জানি। কবিতার কাঠামোতে কিছু শব্দ ঠেসেঠুসে দিলই ভালো কবিতা হয় না। তা রাতপোহালেই ঝরে যায়। এখন কয়টা কবিতা আপনি পাচ্ছেন সপ্তাহে, মাসে, বছরে? আমি যে এত কথা বলছি, আমার কবিতাই কি হচ্ছে। আমাদের কবিতা কতটুকু হচ্ছে? তাই বলে-কি হবে না? নিশ্চয় হবে। এর মধ্য থেকেই হবে। আমাদের মধ্য থেকেই কারো না কারো হবে। কবিতার প্রতি সৎ থাকার বিকল্প নেই। আমরা যত সৎ হতে পারব তত দ্রুত সুসময়টি নাগাল পেতে পারব।



পেখমঃ একটা আদর্শ কবিতা নির্মাণে কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন?

জোবায়ের মিলনঃ  আমায় ক্ষমা করবেন, এর উত্তর আমি দিতে চাই না। এর উত্তর দেয়ার সময় হয়নি। আমি আমার কবিতাতে সুরটি ঠিক রাখার চেষ্টা করি। হোক মাত্রাবদ্ধ বা মুক্তছন্দ। আবার বিষয় ও বক্তব্যটার দিকেও খেয়াল রাখি। আমি যা বলছি তা প্রথমত আমি বুঝতে পারছি কিনা, তারপর বুঝাতে পারছি কিনা, তা-ও খেয়ালে রাখি। থাক, এ বিষয়ে আর না। একটি কথা দুঃসাহস নিয়ে বলি শুধু, আদর্শ বা বিখ্যাত কবিতা পরিকল্পনা করে রচনা করা সম্ভব হয় না, যা হয় তা আপনা-আপনিই হয়ে যায়। অনেক আদর্শ কবিতা কেউ পড়েই না, আবার অনেক অ-আদর্শ কবিতা তুমুল বিখ্যাত। এই বিষয়টি নিয়েও প্রচুর বিতর্কের সুযোগ আছে (ব্যক্তিগত মত)।


পেখমঃ বর্তমান সময়ে পুরস্কার/পদক আদান প্রদানের বিষয়ে অনেক অভিযোগ লক্ষ্য করা যায়। আসলে এর থেকে উত্তোরণের কোন দিক আছে কি?

জোবায়ের মিলনঃ  পুরস্কার নিয়ে কোনো কথা না বলাই শ্রেয়। এগুলো যুগে যুগে ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। পুরস্কার নিয়ে যারা প্রচুর কথা বলে, তাদেরকে আপনি পুরস্কার প্রহণ করতে দেখবেন, শুনবেন। একপক্ষ পুরস্কার দেবে তাদের স্বার্থে, আরেকপক্ষ পুরস্কার গ্রহণ করবে তার স্বার্থে। স্বার্থের বাইরে না কোনোটিই। পুরস্কার কোনো বিষয় না আবার পুরস্কার বিষয়ও। এটি যার যার ভালোলাগার বিষয়। আদান-প্রদান যা-ই বলেন, যা-ই হচ্ছে তা জলের মতো স্বচ্ছ। আয়নার মতো। আপনি আরও দেখবেন, অনেকে যে পুরস্কার নিয়ে কথা বলছে সে একসময় সেই পুরস্কারটি পাওয়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেছে। যে সে পুরস্কারটি পাওয়ার আশায় আছে সে মুখ বন্ধ করে বসে আছে। এটি নিয়ে যত কথা বলবেন ততই পরিবেশটি ঘোলা হবে। বাহির থেকে যারা দেখবে তাদের বিশ্বাস, শ্রদ্ধাটি নষ্ট হয়ে যাবে সাহিত্যের প্রতি। তাই এটি নিয়ে হৈ চৈ করার দরকার আছে বলে মনে হয় না। দরকারি অনেককিছুই তো পড়ে আছে আমাদের। সেদিকে খেয়াল দিলেই হয়। যারা এগুলো নিয়ে অহরহ কথা বলে তারা অতটা ভারী লোক না। পুরস্কার দেয়ার, নেয়ার যেমন একটি পক্ষ আছে তেমনি ওগুলো নিয়ে তেনা প্যাঁচানোরও একটি পক্ষ আছে। সবাই আমাদেরই লোক, কেউ পর না। অস্থির এ সময়ে সাহিত্যের কল্যাণটাই সবার আগে বিবেচনায় রাখা উচিত আমাদের, তারপর সমালোচনা-আলোচনা হতে পারে, তা যেন নীচু এবং নিকৃষ্ট ধরনের না হয়।


পেখমঃ পেখমকে সময় দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।

জোবায়ের মিলনঃ আপনাকেও ধন্যবাদ। পেখমের সঙ্গে যুক্ত সকলকে ধন্যবাদ। কল্যাণ হোক মানুষের, মনের।         

Post a Comment

أحدث أقدم