অরণ্য আপন এর গুচ্ছ কবিতা ।। ঈদ আয়োজন ।। পেখম


মা

ভালোলাগে এই পানি-- গালের ঢালে ধ্যানের মতো থাকে 
খুনের আসামীর মতো দুঃখের ছায়ারা আমাকে গিলে ধরে
চোখের ভিতর ভাঙা রোদের আঁচে অশ্রু চিকচিক করে
বিষণ্ন সাঁঝেরবেলা মায়ের কবর থেকে ডাকে
বুকের দেয়ালে মায়ের নিশ্বাস বেদনার ছবি আঁকে
মায়ের কথা কয় সন্ধ্যারবাতি--- কথা কয় বেদনার
মনে পড়ে, এইতো মা সেজদা দিলেন, তাশাহুদে বসবেন এবার 
বাবা ডাকেন বেগম! নামাজ হল না তোমার?
ছোল আসিছে, ভাত দেও, খেলবের যাবিনি আবার!
এত কথা মনে পড়ে! জলে চোখের আগনে ভরে
মায়ের চুমু এখনও চাঁদ হয়ে আছে কপালের পরে
ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝি সন্ধ্যার জোঁনাকি! এত অন্ধকার পড়েছে ঝরে
দুঃখের মুখোমুখি বসে হৃদয় হয়েছে নীরব অনেকদিন পরে 




আমি শ্রমিক

আমি শ্রমিক, ফুলের গন্ধেও আমার মরণ হতে পারে
মজুরি না হলে
আগুন লাগতে পারে পানির আকাশেও যদি বিনাকারণে ছাটাইয়ের কথা বলে 
গোলাপকেও আমি কবর দিতে পারি
প্রভুকেও আকাশ থেকে নামাতে পারি 
মজুরি না হলে 
হাতকড়া পড়তে পারে স্বাধীনতার হাতে 
যদি বিনাকারণে ছাটাইয়ের কথা বলে 

গোরুর মতো মুখ খুলতে পারে তোমাদের শোক
মুখোশ খুলে দিতে পারে তোমরা কেমন লোক 

এই মাটি আর স্থির থাকবে না 
আকাশ আর আকাশে রবে না
মজুরি না হলে 
আমি শ্রমিক, ফুলের গন্ধেও আমার মরণ হতে পারে 
লিখতে হতে পারে কুকুরের পিঠে কুকুর, শুয়োরের পিঠে শুয়োর, মানুষের পিঠে মানুষ 
যদি বিনাকারণে ছাটাইয়ের কথা বলে

দিনের আলো নষ্ট হয়ে যাবে 
রাতের পর আবার সন্ধ্যা পাবে
মজুরি না হলে 
আমি শ্রমিক, ফুলের গন্ধেও আমার মরণ হতে পারে



মানুষগুলি কোথায়?

ভোর হলে শুধু গাছের প্রার্থনা শুনি
মানুষগুলি কোথায়? 
আমার দেশ আর আমার সঙ্গে হাঁটতে চায় না 
আমার মানুষ আর আমার সঙ্গে হাঁটতে চায় না
তুমি হাঁটবে আমার সঙ্গে? 
এই পথে আমার আম্মা হেঁটে গেছে মাদরাসার পথ ধরে

তুমি হাঁটবে আমার সঙ্গে? 
এখানে নীরবতা আর চিৎকারের মধ্যে নেই কোনও পার্থক্য 
আমি চিৎকার করতে করতে নিজেকে ভরে ফেলেছি
আমি হাঁটতে হাঁটতে নিজের পায়ের নিচে চলে গেছি

আমার দেশ আর আমার সঙ্গে হাঁটতে চায় না 
আমার ভাষা আর আমার ঠোঁটে বসতে চায় না 
আমার হৃদয় আমি পথের নির্জন পাথরে রেখে যাব
আমি চোখের পানির সঙ্গে দৌড়াতে দৌড়াতে পিছিয়ে পড়ে গেছি 
আমার স্বপ্নের মধ্যে নদীর চরের মতো ভোর জেগে উঠেছে 
একটা কালো সূর্য আমার ভোরের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে
আমি সূর্য এবং রাতের মাঝে রং করেছি 

আমার দেশ বুকে দুটি গ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে
মৃত মানুষেরা কাছে ভিড়ছে আর সেলফি তুলছে 
সুডৌল গ্রহের উন্নয়ন নিয়ে পত্রিকার পাতা বড়ো হচ্ছে 
চ্যানেলের স্ক্রলের পর্দা বড়ো হচ্ছে 

আমি আকাশে একটা গোলাপ দেখেছি 
কবরের চোখ অবশ্য শুধু জীবন বিচ্ছিন্ন আকাশই দেখে 
কবরের দালালরা যেমন জান্নাতের প্রেসক্রিপশন লেখে 
এই দেশ আমাকে কবর গুনেছে
এই দেশ আমাকে সংখ্যা গুনেছে 

তোমার মুখটা পুরানো দীর্ঘশ্বাসের মতো গভীর
আর দুঃখের মতো সুন্দর 
আমাকে দেখতে দেবে খোদা?
অনেকদিন আমি তোমার মুখ দেখি না 
তুমি এখন আছ কোথায়? 
ওমরা না হজে?  
তোমাকে মাইরি এখন কারা ভোজে? 

আমাকে পুছ করো 
তুমি পৃথিবী থেকে কি খুঁজে পেয়েছ?
একটা দেশ মানুষ ছাড়া 
একটা ভাষা প্রেম ছাড়া 
একটা মসজিদ খোদা ছাড়া 
একটা মৃত্যু জীবন ছাড়া 
আমার দেশ আর আমার সঙ্গে হাঁটতে চায় না
আমার মানুষ আর আমার সঙ্গে হাঁটতে চায় না 
তার পা আকাশে উঠে গেছে
ভোর হলে শুধু গাছের প্রার্থনা শুনি
মানুষগুলি কোথায়?



প্রেম একটা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি 


কে বাঁচাবে আমাকে 
আমি তো রোজ মরি
খোদা আমাকে একদিন গড়েছে
আমি তো তাকে রোজ গড়ি

কে বাঁধবে আমার ঘর
এ ঘর তো রোজ ভেঙে যায়
কে আমাকে স্বাধীন করবে
আমি তো বন্দি ভালোবাসায়

সে আমার এত কাছে 
তবু তাকে খুঁজতে হয়
কে আছে আমার ভিতর 
তাকে একবার দেখতে হয় 

ওষুধ দেবে দাও
রোগ যেন না সারে 
সুস্থ হলে তো
ভুলে যাব তারে


রিকশাওয়ালা

রিকশার ওপরেই গোটা জীবনটা পার হয়ে গেল
আমি দুই আর রিকশাটা তিন চাকার বাহন
ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষের মামা ডাক শুনে গেল
দিনটা রাস্তায় আর রাতটা বস্তির ঘরে যাপন
ঘরে খিড়কি নেই, এখানে আলো হাওয়া আসে না
গলির মোড়েই মন্দির, বের হতে দেখি না ভগবান 
সুরা ইয়াসিনের মতো লম্বা জীবন, পা আর চলে না 
দুঃখগুলি জমে জমে হয়েছে চেলোপাড়া ব্রিজের সমান
ধিমে বাতির জীবন, দপদপ করে, শেষ  হয়ে যাব
বুকের ব্যথা টনটন করে, মনের ভিতর অসুখ
কিস্তির টাকা দিতে পারি না, ওষুধ কেমনে খাব
বউটা চলে গেছে, কতদিন দেখি না তার মুখ
কত মানুষকে পৌঁছে দিলাম আমি গন্তব্যের ঘরে
আকাশের পাখিটা আজ গাছের ডালে কেঁদে মরে


 

Post a Comment

أحدث أقدم